পাশে বিথির দেহটা পরে আছে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে বিথি, চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পরছে জল। তৃপ্তিসহকারে সিগারেট টানছি,
-কাপড় পরে নাও বিথি, আমাদের বেড় হতে হবে।
-আর কিছুক্ষন থাকিনা।
অনুরোধে বিথির কন্ঠ জরিয়ে আসছে। ও জানে, আমার প্রতি এখন আর কোন অধিকার খাটাতে পারবে না। আজ এখানেই সবটা শেষ হতে চলেছে।
-না, আমার কাজ আছে, এক্ষুনি বেড়ুতে হবে।
-আরতো তোমাকে কখনো বিরক্ত করবো না, আর কিছুক্ষন থাকিনা প্লিজ।
-আহ, তোমার এই শিশুসুলভ আচরন বন্ধ করো।
তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বললাম আমি। বিথি আর কিছু বললো না। ওয়াশরুমে চলে গেলো রেডি হতে। বিথির আবেগ, অনুভুতি, ভালোবাসা, আকুতি, মিনতি সব কিছুর উর্ধে চলে এসেছি আমি। এখন আর ওসব আমাকে ছোঁবে না।
কিন্তু এই আমি একসময় বিথির জন্য পাগলপারা ছিলাম। আজ ও আমার কাছে ফুরিয়ে গেছে।
শুরুটা হয়েছিলো শীতের এক রাতে, রতনের হলুদ ছোঁয়ায়। রতন আমার কলিগ। অর গ্রামের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন করা হয়। সবাই যখন রতনের গালে-কপালে হলুদ মাখছিলো আমি তখন সবার থেকে আলাদা হয়ে ওদের পুকুরপাড়ে বসেছিলাম। সাউন্ড সিস্টেমের হিন্দিগানের শব্দদূষন, এতো এতো ফটোশুট সবকিছু অসহ্য লাগতেছিলো। বসে বসে অনলাইন পত্রিকা পড়তেছিলাম।
-কি ব্যাপার আপনি একা একা এখানে কেনো?
হঠাৎ পাশ থেকে নারীকন্ঠ শুনে বিষ্ময়ে তাকালাম। হলদে শাড়ি পরা, খোঁপায় ফুলের মালা, কপালে টিপ, ঠোটে লাল লিপস্টিক। চমৎকার সুশ্রী একটা মেয়ে। আমি নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে বললাম,
-কোলাহল ভালো লাগছিলো না, তাই এখানে একটু বসে আছি।
-ও আচ্ছা, বসতে পারি এখানে?
-হ্যা বসুন, আপনি হলুদ দিয়েছেন?
-হ্যা, মাত্রই দিয়ে আসলাম। আমারো তেমন কোলাহল পছন্দ না।
-কি নাম আপনার?
-আমি বিথি, আর আমি জানি আপনার নাম। আপনি সোহান, রতন ভাইয়ের কলিগ।
-ও আচ্ছা, এখানেই থাকেন আপনি?
-না, ঢাকা থেকে এসেছি।
প্রায় ঘন্টাখানি আলাপ হলো বিথির সাথে। একাকিত্ব দূর করে দিলো সে। একাএকা খুব বোর হচ্ছিলাম। মেয়েটার সব কিছুই ভালো লাগলো। সাহিত্যপ্রেমী সে, স্বরচিত দু'টা কবিতাও শুনালো।
বিয়ে বাড়িতে যতদিন ছিলাম ভালোই সঙ্গ দিচ্ছিলো আমাকে। রতন বাদে ওখানেতো আমার পরিচিত কেউ ছিলোনা। রতন তো আর আমাকে সময় দিতে পারবে না, বিয়ের বর বলে কথা। বিথি আমার সব খেয়াল রাখছিলো। খাবার সময় কল করে ডেকে নিতো, শোবার জন্য ভালো ব্যবস্থা করে দিতো, বরযাত্রাতেও ও আমার পাশে বসেছিলো। গল্প আড্ডায় বুদ হয়ে ছিলাম তার সাথে। মনেই হচ্ছিলোনা মাত্র দু'দিনের পরিচয়।
ঢাকায় ব্যাক করার পরে নিয়মিত কথা হতো আমাদের। ও আমাকে আভাস দিচ্ছিলো ভালোবাসার। আমারো না করার কোন কারন ছিলোনা। প্রপোজ করে লুফে নিলাম তাকে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ মনে হচ্ছিলো। বিথির প্রতি একবিন্দু অবিশ্বাস হতোনা। ও যা বলতো তাই বিশ্বাস করতাম, যতক্ষন না শ্রাবনের মেঘ জরো হলো।
এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় অফিসে আটকে পরেছিলাম। ভারি বর্ষনে রাস্তায় কোমর অব্দি পানি, গাড়ি চলাচলে অনুপযুক্ত। রতন আর আমি অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
রতন তখনো জানতো না আমার আর বিথির সম্পর্কের কথা। বিথি নিষেধ করেছিলো বলতে, পারিবারিক ঝামেলা হতে পারে ভেবে। আমিও কাউকে কিছু বলিনি। সেদিনই প্রথম বিথির কথা তুললাম,
-তর বিয়েতে একটা মেয়ের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, বিথি নাম।
-ও আচ্ছা, ক্রাশ খেয়েছিস নাকি রে?
আমি মুচকি হাসলাম, কোন প্রতিউত্তর দিলাম না। রতনই বলা শুরু করলো।
-ক্রাশ খেলেও কোন লাভ নাই রে, তার স্বামী নেভী অফিসার। সমুদ্রে চুবিয়ে মারবে একেবারে।
এটা বলেই হাসতে থাকলো রতন। আমি থমকে গেলাম। বজ্রপাতের ধ্বনি মাথায় এসে লাগছে। সারাদুনিয়া উলটপালট হয়ে গেলো আমার। বৃষ্টির মধ্যেই বাসায় এসে পরলাম। কিভাবে এসেছি নিজেও জানিনা। সেলফোন ভিজে ডাউন হয়ে গেছে। ল্যান্ড ফোনে বিথির বাসার ফোনে ডায়াল করলাম। ও আমাকে নিষেধ করেছিলো বাসার নাম্বারে কল করতে। আমি আজ কোন নিষেধ শুনবো না। কল রিসিভ হতেই হ্যালো বললাম, এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসলো ওপাশ থেকে।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-বিথিকে দেয়া যাবে?
-ওতো কিচেনে, আপনি কে বলছেন?
-আমি বিথির ফ্রেন্ড, আপনি কে?
-আমি তার হাসবেন্ড, একটু লাইনে থাকুন আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি।
বিশ্বাসটা একদম লন্ডভন্ড হয়ে গেলো। প্রচন্ড ঘৃনা হতে থাকলো বিথির প্রতি। এভাবে আমাকে নিয়ে খেলতে পারলো সে? ছিঃ। যে পরকিয়াকে ঘৃনা করে আসছি সেই পরকিয়ার স্বিকার আমি। ছিঃ। সেদিন থেকে সিগারেট ধরলাম। কিন্তু সেটাতে কি আর দুঃখ দূর হয় নাকি! বিভিন্ন মাদক নেয়াও শুরু করলাম। ঠিকঠাক অফিসেও যাই না। জীবনটাকে বিষাক্ত মনে হয়।
বিথি কয়েকদিন ফোন দিয়ে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলো। বারবার বুঝাতে চাচ্ছিলো, সে বিবাহিত না সে আমাকে ভালোবাসে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তার এই ঠুনকো চেষ্টা সবই বৃথা গেলো।
ক্রমশ আমি অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। বিথিকে প্রচন্ড ঘৃনা করা শুরু করলাম।
সে এভাবে আমার মনটা ভেঙ্গে দিলো কিন্তু তার কি কোন শাস্তি দেবোনা আমি? মাঝে মাঝে এই ভেবে প্রতিশোধ নেয়ার কথা চিন্তা করতাম। আবার ভাবতাম, থাকনা, সে না হয় ছলনা করেছে আমিতো সত্যি তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি করবোনা, ভালো থাকুক ও অর মতো।
একদিন কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দরজা খোললাম। দরজার ওপাশে বিথি। ইচ্ছে করছিলো দুটো চড় মেরে তারিয়ে দেই। কিন্তু প্রচন্ড মদ খাওয়াতে নিজেই ছিলাম বেসামাল। বিথি আমার বাসায় প্রবেশ করলো। বাসার অবস্থা ডাসবিনের মতো হয়ে আছে। চারদিকে সিগারেটের প্যাক আর মদের বতল পরে আছে। আমি সোজা যেয়ে খাটে শুয়ে পড়লাম। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। বিছানাতে উঠে বসলাম। অবাক হয়ে নিজের রুম দেখলাম। জিনিসপত্র সব সুন্দর করে গুছানো। সোফাতে বসে বিথি টিভি দেখছে।
-কি ব্যাপার? তুমি এতো রাতে এখানে কি করো? বাসায় যাওনি কেন?
-যাবোনা আজ বাসায়। ফ্রেশ হয়ে আসো, তোমার জন্য খাবার তৈরি করেছি।
-এক্ষুনি বেড় হ আমার বাসা থেকে। তর মুখ আমি দেখতে চাইনা। চলে যা ডাইনি।
-প্লিজ, মুখ খারাপ করোনা। শান্ত হও।
-**************
-হ্যা আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছি। আমি আমার সম্পর্কে মিথ্যে বলেছি। কিন্তু আমার ভালোবাসা মিথ্যে নয়। সত্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি।
-নিকুচি করি তোর ভালোবাসার। এটা ভালোবাসা না এটা পরকিয়া। (আর কিছু গালি দিলাম।)
-প্লিজ তুমি আমার কথা শুনো। আমাকে যা বলার বলো যত পারো গালি দাও, কিন্তু আমার ভালোবাসাকে অপমান করোনা।
-আবারো তুই মুখে ভালোবাসার কথা বলিস? তর মুখে এসব মানায় না। তুই একটা ব্যশ্যা।
-একটু শান্ত হও সোহান। আমার কথা শুনো প্লিজ।
বিথি অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে আর অর কথা বলে চলেছে। তার স্বামী তাকে ভালোবাসেনা। টাকার জন্য নাকি তাকে বিয়ে করেছিলো। তার স্বামী তাকে রেখে নিয়মিত পতিতালয়ে যায়। সে স্বামীর কাছে কোন ভালোবাসা পায়নি।
আমি তার কোন কথাই এখন আর বিশ্বাস করিনা। তার নাটক আমি ধরে ফেলেছি।
-তুমি বেড় হয়ে যাও বিথি। যা করেছো ভালোই করেছো। আমি তোমাকে আর কিছু বলতে চাইনা। অভিযোগ নেই তোমার প্রতি, ক্ষমা করে দিলাম। যাও তুমি। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।
-তুমিতো নিজেকে শেষ করে ফেলতেছো সোহান। এভাবে চললেতো বাঁচতে পারবা না তুমি।
-এতোই যদি আমার খেয়াল থাকতো তাহলে আমার মন নিয়ে খেলতে পারতা না। এখন এই আলগা পিরিতি দেখানো স্টপ কর।
-সোহান, আমি জানি আমি খুব খারাপ। তবুও আমি তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ তুমি এমনটা করোনা। আমাকে যা শাস্তি দেবার দাও। নিজের ক্ষতি করোনা।
আমি অসহ্য হয়ে তাকে জোর করে ঘর থেকে বেড় করে দিলাম।
এরপরও ও আমার কাছে চলে আসতো। ফোন করতো। বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতো। জীবনকে সুন্দর করতে বলতো। আমি প্রচন্ড ঘেন্না করি তাকে। খুব গালিগালাজ করে তাকে তারিয়ে দিতাম। ও শুধু আমাকে ভালো হয়ে চলতে বলতো। একদিন আমি মেনে নিলাম তার কথা। বিনাদোষে কেনো জ্বলে মরবো? এমন খারাপ মেয়ের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করবো না। আমি ঘুরে দাড়াবো। ঘুরে দাড়ানোর জন্য চাই শক্তি, আমি অর প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে শক্তি অর্জন করবো।
একদিন ও আমার বাসায় আসলো। আগের মতো তারিয়ে দিলাম না। আমি আজ ভালো ব্যবহার করলাম তার সাথে। সুন্দর করে বললাম,
-তুমিতো চাও, আমি যেনো ভালোমতো চলি, এসব মাদক যাতে আর না ছুঁই। ঠিকঠাক করে যাতে কাজ করি। তাইনা?
-হ্যা।
-আচ্ছা, আমি এসব ছেড়ে দেবো। বিনিময়ে আমি তোমার শরীর চাই। যদি দাও তাহলে কথা দিচ্ছি, আমি আর মাদক নিবোনা। এরপর তুমিও কোন যোগাযোগ রাখবা না আমার সাথে। আমি সুস্থ ভাবে জীবনযাপন করবো।
বিথির চোখে অশ্রু চলে আসলো। ও কিছুক্ষন কান্না করে বললো,
-ঠিক আছে। তুমি যা চাও তাই হবে।
আমি আমার ভালোবাসার প্রতিশোধ নিয়ে নিলাম ওর দেহের উপর। বিথি চলে গেলো।
এরপর ঠিকঠাক ভাবে চলতে থাকলাম। বিথিও আমাকে আর কল দেয় না, বাসাতেও আসেনা। যোগাযোগ একদম স্টপ। সপ্তাখানিক ভালোই চললো।
অফিসের কাজ করছিলাম আমি, রতনও পাশে ছিলো। কথা প্রসঙ্গে রতন বললো,
-সেদিন তুই একটা মেয়ের কথা বলেছিলি না? ঐ যে বিথি নাম।
-হ্যা।
-ও সুইসাইড করেছে।
-মানে?
-হুম, সপ্তা খানি আগে।
টপটপ করে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পরলো। কোন মতে রতনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
একটা খারাপ মানুষ মরেছে, তাতে চোখটা এতো জ্বালা করছে কেনো? বুকটাই বা পোড়াচ্ছে কেনো?
লিটারে লিটারে এলকোহল আজো সেই জ্বালা কমাতে পারেনা