যাকাত- ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিধান। কুরআন শরীফে আল্লাহ তা’আলা যখনই নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, পাশাপাশি অধিকাংশ ক্ষেত্রে যাকাত আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “নামায কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো”।
যাকাত সম্পর্কে কুরাআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তিন স্থানে ভিন্ন ভিন্নভাবে হুকুম দিয়েছেন। সূরা আল বাকারায় বলা হয়েছে:
اِنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الارْضِ ـ
তোমরা নিজেরা যে পবিত্র ধন-সম্পদ উপার্জন করছেো এবং জমি থেকে যে ফসল আমি তোমাদের দান করেছি-এসব কিছু থেকে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো। সূরা আল বাকারা : ২৬৭।
সূরা আল আনআমেও এ প্রসংগে বলা হয়েছে যে, আমিই তোমাদের জন্য যমীনে বাগিচা এবং ক্ষেত-খামার তৈরি করেছি। অতএব: ১৪১
كَلُوْ مِنْ ثَمَرِه اَثْمَرَ وَاتُوْا حَقَّه يَوْمَ حَصَادِه ـ الانعَام ـ 141
(বাগান এবং ক্ষেত) যখন ফল বা ফসল ফলবে তখন তোমরা তা থেকে নিজেদের খাবার সংগ্রহ কর এবং ফল বা ফসল কাটার দিন তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য আদায় করো। সূরা আল আনআম: ১৪১
এ উভয় আয়াতেই জমির ফসলের যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ফিকাহ শাস্ত্রবিদগগণের মতে প্রাকৃতিক সম্পদ-কাঠ, ঘাস এবং বাঁশ ইত্যাদি ভিন্ন সকল প্রকার শস্য তরবারী ও ফলে আল্লাহর পাওয়া রয়েছে এবং তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, বৃষ্টি, নদী ও সমুদ্রের পানি থেকে যেসব ফসল জন্মে তাতে মোট ফসলের এক-দশামাংস আল্লাহর প্রাপ্য এবং যে জমিতে মানুষকে কৃত্রিম উপায়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাতে আল্লাহর অংশ নির্ধারিত হয়েছে মোট ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ। এ উভয় প্রকার অংশই শস্য কর্তনের সাথে সাথেই আদায় করা ওয়াজিব।
এর পর সূরা তাওবায় বলা হয়েছে:
وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الْذِّهَبَ وَالْفِصَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلَيْمٍ ـ يَّوْمَ يَحْمى عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوْى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذّا مَاكَنَزْتُمْ لاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ ـ التوبة : 34-35
যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় মোটেই খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেই দিনের আযাবের কথা জানিয়ে দাও যেদনি সোনা ও রূপা আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে, পাঁজরে ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। আর তাদেরকে বলা হবে যে, এটাই হচ্ছে তোমাদের নিজেদের জন্য সঞ্চিত সেই ধন-সম্পদ। তোমরা যা কিছু সঞ্চয় করেছিলে এখন তারই স্বাদ গ্রহণ করো। সূরা আত তাওবা : ৩৪-৩৫
অতপর বলা হয়েছে:
اِنًَّمَا الصَّدَقتُ لِلْفُقََرَآءِ وَالْمَسْكِيْنَ وَالْعمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤْلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِىْ الرَّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَاَبْنِ السَّبيْلِ فَرِيْضضةٌ مِّنْ اللهِ ـ التوبة : 60
যাকাত আল্লাহর নির্ধারিত ফরয। এটা দেয়া হবে ফকীর, মিসকীন এবং যাকাত উসুলকারী কর্মচারীদেরকে, ভিন্ন ধর্মের লোকদের মন জয় করা, দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ লোকদের মুক্তির ব্যবস্থা করা, ঋণী লোকদের ঋণ শোধ করা, আল্লাহ নির্ধারিত সার্বজনীন কাজে এবং নি:স্ব পথিকদের সাহায্যার্থেও এটা খরচ করা হবে। সূরা আত তাওবা : ৬০
এরপর আল্লাহ বলেছেন:
خَذُ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تَطَهِّرُهُمْ وَتُزْكِّهِمْ : التورة : 103
তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন করে দাও। সূরা আত তাওবা : ১০৩
উল্লেখিত তিনটি আয়াত থেকেই জানা যায় যে, যেসব সম্পদ সঞ্চয় করা হবে এবং পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে তা থেকে যদি আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়, তবে না নাপাক হবে, তা পবিত্র করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য অংশ উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করা। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, সোনা ও রূপা সঞ্চয়কারীদের সম্পর্কে যখন এ আযাবের সংবাদ আসলো, তখন মুসলমান জনসাধারণ অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এ আয়াতে অনুসারে তারা মেন করেছিল যে, কারো কাছে এক পয়সাও জমা রাখা অন্যায়, সব খরচ করে দিতে হবে। অবশেষে হযরত উমর ফারুক (রা) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের এ উৎকন্ঠার কথা জানালেন। হযরত রাসূল (সা) বলেন: আল্লাহ তোমাদের প্রতি যাকাত এজন্যই ফরয করেছেন যে, তা আদায় করলে অবশিষ্ট ধন তোমাদের জন্য পবিত্র ও হালাল হয়ে যাবে। হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রা) থেকেও এরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে পাক (সা) বলেছেন, তোমার মাল থেকে যখন যাকাত আদায় করে দিল, তখণ তোমরা প্রতি যা অবশ্য কর্তব্য। (ওয়াজিব) ছিল তা তুমি আদায় করলে।
উল্লেখিত আয়াত থেকে শুধু সোনা-রূপার যাকাতের নির্দেশ জানতে পারা যায়; কিন্তু হাদীস থেকে জানা যায় যে, ব্যবসায়ের পণ্য, উট, গরু-ছাগলেরও যাকাত আদায় করতে হবে। রূপার সাড়ে বায়ান্ন তোলায় এবং স্বর্ণের সাড়ে সাত তোলায় যাকাত ফরয হয়। চল্লিশটি ছাগল এবং ত্রিশটি গরুতে যাকাত দিতে হবে এবং ব্যবসায়ের পণ্যের মূ্ল্যে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূ্ল্যের সমান হলে যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ এ নির্দিষ্ট পরিমাণ যার কাছে বর্তমান থাকবে এবং এভাবে তার একটি বছর সময় অতীত হবে, তাকে এ চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত বাবদ আদায় করতে হবে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন যে, আলাদা আলাদাভাবে সোনা ও রূপার যাকাত ফরয হওয়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ যদি বর্তমান না থাকে, কিন্তু দুটিরই সমষ্টিগত মূল্যে যাকাতের পরিমাণ(নেসাব) পর্যন্ত পৌছে তবে তা থেকেও যাকাত আদায় করতে হবে।
হযরত উমর ও ইবনে মাসউদ (রা) এর মতে সোনা রূপার অলংকার যাকাত আদায় করা ফরয। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহহি আলাইহহিস এর মত-ই গ্রহণ করেছন। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলে (সা) দুজন স্ত্রীলোকের হাতে স্বর্ণের কংকন দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা যাকাত আদায় করে কিনা। একজন উত্তরে বললো-না। হযরত (সা) বললেন, আজ যাকাত আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তোমার হাতে আগুনের কংকন পরতে তুমি রাজী হবে কি? হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর কাছে পাঁজেব নামক এক প্রকার স্বর্ণের অলংকার ছিল। তিনি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কি সঞ্চিত ধনের শামিল? হযরত রাসূল (সা) বললেন, এর পরিমাণের ওপর যদিযাকাত ফরয হয় আর তা থেকে যাকাত আদায় করা হয়; তবে ওটা নিষিদ্ধ সঞ্জয় নয়। এ উভয় হাদীস থেকে জানা যায় যে, সোনা-রূপার অলংকার হলেও তাতে যাকাত ফরয হবে – যেমন মওজুদ সোনা-রূপার ওপর ফরয হয়। অবশ্য হীরা-জহরত বা আংটির কারুকার্যের জন্য যাকাত দিতে হয় না।
কালামে পাকে যাকাত পাবার যোগ্য আট শ্রেণীর লোকের কাথা উল্লেখিত হয়েছে। এখানে তাদের বিবরণ দেয়া হচ্ছে:
গরীব: যাদের কাছে কিছু না কিছু ধন-সম্পদ আছে কিন্তু তা তাদের যাবতীয় প্রয়োজেন পূর্ণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, খুবই টাটাটানির ভেতর দিয়ে যাদের জীবন অতিবাহিত হয়, তদুপরি কারো কাছে কিছু চাইতেও পারে না, এর গরীব। ইমাম জুহুরী, ইমাম আবু হানীফা, ইবনে আব্বাস, হাসান বসরী, আবুল হাসান করখী এবং অন্যান্য ফকীহগণ এদেরকেই ফকীর বা গরীব বলে অভিহিত করেছেন।
মিসকীন: যেসব লোকের অবস্থাও আরও খারাপ, পরের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়, নিজের পেটের অন্নও যারা যোগাড় করতে পারে না তারা মিসকীন। যারা সক্ষম কিন্তু বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে হযরত উমর রাদিয়াল্লুহ আনহু তাদেরকেও মিসকীনদের মধ্যে গণ্য করেছেন।
যাকাত বিভাগের কর্মচারী: ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য যাদেরকে কর্মচারী নিযুক্ত করবে, তাদেরকেও যাকাতের অর্থ থেকেই বেতন দেয়া হবে।
যাদের মন রক্ষা করতে হয় : ইসলামের সহায়তার জন্য কিংবা ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য যাদেরকে টাকা দেয়ার প্রয়োজন তারা এর অন্তর্ভূক্ত। সেই সকল নও-মুসলিমও এর অন্তর্ভূক্ত জাতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সাথে মিলিত হবার কারণে বেকার সমস্যা বা আর্থিক অনটনে পড়ে গেলে তাদের সাহায্য করা মুসলমানদের একটি জাতীয় কর্তব্য। এমনকি তারা ধনী হলেও তাদেরকে যাকাত দেয়া উচিত। এতে তারা ইসলামের ওপর অধিকতর আস্থাবান হবে। হোনাইনের যুদ্ধে জয়ের পর হযরত নবী (সা) নও-মুসলিমদের গনীমতের বহু সম্পদ দান করেছেন। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাগে একশ উট পড়েছিল। আনসারগণ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এরা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে আমি তাদেরকে খুশী করতে চাই। এ হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম জুহুরী বলেছেন, যেসব ইয়াহুদী-খৃষ্টান-মুসলামান হবে বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী ইসলাম কবুল করবে, তারা ধনী হলেও তাদের যাকাত দেয়া হবে।১
গোলাম ও কয়েদীদের মুক্তি বিধান: যে ব্যক্তি দাসত্ব শৃংখলে বন্দী হয়ে আছে এবং যে মুক্তি পেতে চায়, তাকেও যাকাতের অর্থ দেয়া যায়। উক্ত অর্থের বিনিময়ে সে মালিকের দাসত্ব শৃংখলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। বর্তমান যুগে দাস প্রথার প্রচলন নেই। তাই আমি মনে করি যেসব লোক কোন ব্যাপারে জরিমানা আদায় করতে অক্ষম বলে কয়েদ ভুগতে বাধ্য হয়, যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদের মুক্তি বিধান করা যেতে পারে-করলে তাও এ বিভাগই গণ্য।
ঋণী ব্যক্তির ঋণ শোধ : যেসব লোক ঋণী অথবা ঋণ আদায় করার সম্বল যাদের নেই, তাদেরকেও যাকাতের টাকা দ্বারা ঋণ ভার থেকে মুক্তি দেয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে একজনের কাছে হাজার টাকা থাকলেও সে যদি একশ টাকার ঋণ হয় তাহলে তাকে কিছুতেই যাকাত দেয়া যাবে না। তবে যে ব্যক্তির ঋণ শোধ করার পর যাকাত ফরয হতে পারে, এপরিমাণ অর্থ যদি তার কাছে না থাকে তবে তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এটাও বলেছেন যে, যারা অপচয় এবং বিলাসিতা ও কু-কাজ করে ঋণী হয়, তাদেরকে যাকাত দেয়া মাকরূহ। কারণ এমতাবস্থায় তাদেরকে যাকাত দিলে সে ধন-সম্পদের আরও অপচয় করবে এবং যাকাত নিয়ে ঋণ শোধ করার ভরসায় সে আরও অধিক ঋণ গ্রহণ করবে।
আল্লাহর পথে :আল্লাহর পথে শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলমানদের সমস্ত নেক কাজেই যাকাতেরই টাকা ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাহায্য করা। নবী করীম (সা) বলেছেন যে, ধনী ব্যক্তির পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয় কিন্তু ধনী ব্যক্তিই যদি জিহাদের জন্য সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তবে তাকেও যাকাত দিতে হবে: কারণ এই যে, এক ব্যক্তি ধনী হতে পারে ; কিন্তু জিহাদের জন্য যে বিরাট ব্যয় আবশ্যক, তা সে শুধু নিজের অর্থ দ্বারা পূরণ করতে পারে না। তার এ কাজের জন্য তাকে যাকাতের টাকা সাহায্য করা যাবে।
১. এ বিষয়ে ইসলামী আইনের বিস্তৃত বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়। এজন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা তাওবা তাফসীর দ্রষ্টব্য।
পথিক-প্রবাসী: পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়ীতে যত ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন এই যে, ওপরে যে আট শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হলো তাদের মধ্যে কাকে কোন অবস্থায় যাকাত দেয়া উচিত আর কোন অবস্থায় না দেয়া কর্তব্য- এ সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করা যাচ্ছে:
এক: কোন ব্যক্তি নিজের পিতা বা পুত্রকে যাকাত দিতে পারে না, স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না। এ সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। কোনো কোনো ফিকাহ শাস্ত্রকার এটাও বলেছেন যে, যেসব নিকটাত্মীয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তোমার ওপর; যারা শরীয়াত অনুসারে তোমার উত্তরাধীকারী, তুমি তাদেরকে যাকাত দিতে পার না; অবশ্য দূরবর্তী আত্মীয় তোমার যাকাত পাবার অধিকারী হবে। বরং অন্যান্য লোকদের অপেক্ষা তাদের অধিকার বেশী স্বীকৃত হবে। কিন্তু ইমাম আওজায়ী বলেছেন যে, যাকাত দেবার জন্য কেবল নিজের আত্মীয় এগানাই তালাশ করো না।
দুই : যাকাত কেবল মুসলমানই পেতে পারে। অমুসলমানগণ যাকাত পেতে পারে না। যাকাতের সংজ্ঞা সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে : تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَاءَ كُمْ وَتُرَدُّ عَلى فُقَرَاءَ كُمْ ـ যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। অমুসলমান গরীবকে সাধারণ দান-খয়রাত অবশ্যই দেয়া হবে। বরং সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করে মুসলমানকে দেয়া এবং অমুসলামানকে না দেয়া আদৌ সমীচীন নয়।
তিন :ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউছুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ(সা) বলেনে যে, প্রত্যেক এলাকার যাকাত সেই এলাকার গরীবদের মধ্যেই বন্টন করতে হবে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাতের অর্থ প্রেরণ করা ঠিক করা। কিন্তু কোনো এলাকায় যাকাত গ্রহণ করার মত লোকই যদি না থাকে কিংবা অন্য এলাকায় যদি এমন কোনো বিপ এসে পড়ে, যে জন্য দূরবর্তী এলাকা থেকে যাকাতের অর্থ সেখানে প্রেরণ করা অত্যন্ত জরুরী বোধ হয়, যথা-প্লাবন, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি; তবে তদনুযায়ী যাকাত বন্টন করা কোনো দোষের কাজ নয়। ইমাম মালেক ও ইমাম সুফিয়ান সাওরীর মতও প্রায় এরূপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাত প্রেরণ একেবারেই অসংগত বা নাজায়েয নয়।
চার: কোনো কোনো লোকের মতে যারা দু বেলা খাবার ব্যবস্থা আছে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। আবার কেউ কেউ বলেছন, যার কাছে দশ টাকা মওজুদ আছে,অন্য একজনের মতে যার কাছে সাড়ে বার টাকা আছে তার যাকাত নেয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা এবং হানাফী মাযহাবের অন্যান্য আলেমগণ বলেছেন যে, যার কাছে পঞ্চাশ টাকার কম নগদ সম্পত্তি থাকবে সে যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। বাড়ী ঘরের জিনিসপত্র এবং ঘোড়া ও চাকর এর মধ্যে গণ্য হবে না। অর্থাৎ এসব দ্রব্যাদি থাকা সত্ব্বেও যার পঞ্চাশ টাকার কম সম্পত্তি আছে, সে যাকাত পেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি জিনিস হলো আইন আর অপরটি হলো ফযীলতের মান। এ দুটি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য আছে।
ফযীলতের মান সম্পর্কে হযরত রাসূল (সা) বলেছেন, যার সকাল ও সন্ধ্যার খাদ্যের ব্যবস্থা আছে সে যদি লোকদের কাছে প্রার্থনা করে তবে সে নিজের জন্য আগুন সঞ্চয় করে। অন্য হাদীসে নবী করীম (সা) বলেছেন, মানুষের কাছে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করা অপেক্ষা কাঠ কেটেও যদি নিজের অন্ন সংস্থান করা হয়, তবে তাই আমার কাছে অধিক মনোনীত। তৃতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, যার কাছে খাদ্য আছে কিংবা যার উপার্জন করার শক্তি আছে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। মানুষের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জাগাবার জন্যেই এটা হযরতের শিক্ষা-এটা আইন নয় আইনের একটি শেষ সীমা নির্দেশ করা হয়েছে এবং কতদূর পর্যন্ত মানুষ যাকাত নিতে পারে তা বলে দেয়া হয়েছে । একটি হাদীসে রাসূলে পাক (সা) করেছেন-
لِلسَّائِلِ حَقٌ وَاِنْ جَاءَ عَلَى الْفَرَسِ ـ
ভিক্ষাপ্রার্থী ঘোড়ায় চড়ে আসলেও তাকে ভিক্ষা দিতে হবে।
এক ব্যক্তি হযরতের কাছে জিজ্ঞাসা করলো, আমার কাছে দশ টাকা থাকলে আমি মিসকীনদের মধ্যে গণ্য হবো? হযরত বললেন, হাঁ। একবার দু ব্যক্তি হযরতের কাছে যাকাত চেয়েছিল। হযরত রাসূল (সা) তাদেরকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন এবং বললেন: তোমরা নিতে চাইলে আমি তোমাদেরকে দেব বটে, কিন্তু মূলত ধনী এবং সক্ষম লোকদের এতে কোনো অংশ নেই। এসব হাদীস থেকে পরিস্কা জানা যায় যে, যাকাত ফরয হওয়া নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ যাদের নেই তারাও গরীবদের মধ্যে গণ্য হয় এবং তাদেরকেও যাকাত দেয়া যেতে পারে। বলাবাহুল্য যাকাত পাওয়ার প্রকৃত অধিকারী কেবল যথার্থ অভাবগ্রস্ত লোক হতে পারে।
যাকাতের জরুরী নিয়ম-কানুন এখানে বর্ণিত হলো; কিন্তু এ প্রসংগে একটি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমি বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। কারণ যে কথাটি আমি বলতে চাই, বর্তমান মুসলমানগণ তা ভুলে গেছে। তা এই যে, ইসলামের সমস্ত কাজই দগত ও সমষ্টিগতভাবে সম্পন্ন করতে হয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যমূলক বিচ্ছিন্নতা ইসলাম সমর্থন করে না। মসজিদ থেকে দূরে অবস্থিত কোনো মুসলমান যদি একাকী নামায পড়ে, তবে নামায হবে বটে, কিন্তু ইসলামী শরীয়াতের জামায়াতের সাথে নামায পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-মুসলমান জামায়াতের সাথেই নামায আদায় করুক, এটাই শরীয়াতের কাম্য। কালামে পাকে এ দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে:
خُذْْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةٌ تُطَهِّرُ هُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا التوبة 103
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হযরত রাসূলে করীম (সা) মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করতে আদেশ দিয়েছেন। মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় অর্থ অংশ নির্দিষ্ট করার অর্থ এই যে, মুসলমানদের ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান সকলেরর কাছ থেকে যাকাত আদায় করবে এবং সমষ্টিগতভাবে তা খরচ করবে। নবী করীম (স) একথা বলেছন:
اُمِرْتُ اَنْ اَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنْ اغْنِيْاَءِ كُمْ وَاَرُدُّهَا فِىْ فُقَرَاءِ كُمْ ـ
অর্থাৎ তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। নবী করীম (সা) এবং খেলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও যাকাত আদায়ের এ পদ্ধতি কার্যকর ছিল। ইসলাম রাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ সমস্ত যাকাত উসুল করতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তা রীতিমত বন্টন করা হতো।