
বাসে একটি স্মার্ট মেয়ে হা করে ঘুমাচ্ছে!
একেকজন একটু পরপর আড়চোখে তাকিয়ে
দেখছে। ব্যাপারটা মোটেও ভাল দেখাচ্ছে
না।
যেহেতু আমি তার যাত্রী প্রতিবেশী.. মানে
পাশের সিটে বসা, তাই আমারও একটা
দায়িত্ব আছে মেয়েটিকে ঘুম থেকে একটু
জাগিয়ে দেয়া। নয়তো একেক জনের
তাকিমাকি এভাবে লেগেই থাকবে।
.
বুদ্ধি খাটিয়ে বাসের জানালাটা খুলে দেয়ায়
অজুহাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। মেয়েটাও এবার
একটু নড়েচড়ে বসলো। হাতদিয়ে টেনেটুনে
জামাটা ঠিকঠাক করে নিল। খোলা জানালায়
দমকা বাতাসে মুখের উপর পড়েথাকা চুলগুলো
পুরোটুক সরে যায়। এই প্রথম মেয়েটার দিকে
ভালোভাবে তাকালাম। দেখে আমিও আর
দশজনের মত চমকে গেলাম! ধবধবে সাদা গালে
স্পষ্ট পাঁচ আঙুলের লালচে ছাপ! চোখ পড়তেই
মেয়েটি চুল দিয়ে আবারো গালটি কেশের
আড়াল করে রাখলো।
বিষয়টা একটু ভাবিয়ে তোলে আমাকে।
.
মেয়েটির কোল ঘেসে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট
একটি বাচ্চা মেয়ে। বয়স আনুমানিক তিন
থেকে সাড়েতিন হবে। মা নিজেই দেখতে
একটি পুতুলের মতন, তারও আবার নাকি কোলে
একটি পুতুল আছে! সত্যিই অনেক মিষ্টি একটা
ব্যাপার!
কিন্তু কি হয়েছে তাদের? বাসে উঠে মা
মেয়ে দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুম!
.
সময়টা মধ্যরাত। বাসটি কিছু সময়ের বিরতিতে
একটি বড়সড় হোটেলের সামনে গিয়ে থামলো।
একে একে যাত্রী গুলো নেমে যাচ্ছে। আমার
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বিরতিতে বাস থেকে
নামার অভ্যাস নেই।
.
পাশে বসে থাকা সেই মেয়েটি কিছুটা
সংকোচ নিয়ে বলে উঠলেন...
--> ভাইয়া, আপনি কি এরমধ্যে বাহিরে
যাবেন?
--- না, তেমন প্রয়োজন নেই। কেন? কিছু
লাগবে?
--> আসলে, বাচ্চাটা ঘুমচ্ছে.. আমি একটু
বাহিরে যেতে চাচ্ছিলাম, যদি একটু ওকে
খেয়াল রাখতেন......
--- আচ্ছা আচ্ছা.. বুঝতে পেরেছি... আমি
এখানেই আছি সমস্যা নেই।
মেয়েটা কৃতজ্ঞতা সুলভ হাসি দিয়ে বাস
থেকে নেমে গেল।
,
মায়ের উষ্ণ কোলে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটি
শক্ত সিটে মাথাঠেকানোর দু'মিনিটের মধ্যেই
জেগে উঠে। ডানে বায়ে তার মা'কে খুঁজে না
পেয়ে ঠোট জোড়া বাঁকিয়ে "আম্মু...আম্মু..."
বলতে বলতে কেঁদে দেয়!
মহাবিপদ!
"আম্মু এক্ষুনি চলে আসবে.. তোমার জন্য
চকলেট আনতে গিয়েছে" এটা সেটা আরো
নানা কিছু বোঝাতে লাগলাম, কোনো
কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
সামনের সিটে বয়স্ক দম্পতি বসে আছেন। আর
তার পাশেই বসে আছে দু'টি ভার্সিটি পড়ুয়া
মেয়ে... এই ক'জন আমার মতই বাস থেকে
নামেনি। এদিকে কান্নার শব্দে তাদের ঘুমটাও
নষ্ট হয়ে যায়। বয়স্কা মহিলাটি আমার দিকে
তাকিয়ে বলে উঠলেন... "আহারে.. কিভাবে
কাঁদছে মেয়েটা! বাচ্চাটাকে একটু কোলে
নাও"
দ্রুত কোলে তুলে নিলাম।
ধীরে ধীরে কান্না থামলো। সম্ভবত বাচ্চাটির
মাথায় কিছু একটা এসেছে। গোলটি গোলটি
চোখ নিয়ে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে
তাকিয়ে আছে। নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করছে
"তুমি কি আমার নতুন আব্বু??!"
.
আমি বিস্মিত হয়ে ভাবতে লাগলাম "নতুন আব্বু"
এটা আবার কেমন কথা! কিছু বলার আগেই
মেয়েটা হাসি মুখে ড্রেসের ডিজাইনকরা
ছোট্ট পকেট থেকে একটি চকলেট বের করে
এগিয়ে দিয়ে বলে "আব্বু... এইটা তোমার
জন্যে!!"
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলি "আমিতো
চকলেট খাই না"
বাচ্চাটি (চিকন সুরে)..... "না না আব্বু এটা
তোমাকে নিতেইইই হবে!" এই বলেই আমার
শার্টের বুক পকেটে সেটি গুঁজে দেয়!
পাশের সিটে বসা মেয়ে দুটি একজন
আরেকজনকে ডেকে বলতে লাগে... "এই দেখ
দেখ কি কিউট রে বাচ্চাটা"
চোখেচোখ পড়তে আমাকে জিজ্ঞেস করে...
"আপনার মেয়েটাতো অনেক কিউট! কি নাম
ওর??"
আমি আমতা আমতা করে বলে যাই.. "আসলে
বাচ্চাটা আমার না, পাশের সিটে বসা
মেয়েটির"
বয়স্কা মহিলাটি একটু অবাক হয়ে আমার
দিকে ঘুরে তাকালেন!
--- তোমার মেয়ে না?! তাহলে তোমাকে আব্বু
বলে ডাকছে কেন??
--> আমিও জানিনা খালাম্মা, ঘুম থেকে উঠে
সে আমাকে নতুন আব্বু বলে ডেকে যাচ্ছে!
--- কি আশ্চর্যকথা! (কিছুক্ষণ চুপ থেকে)
বাচ্চাটি কোনো বিপদে পড়েনিতো?!
মেয়েটা বাসে উঠার পর থেকেই তাকে একটু
অন্যরকম দেখাচ্ছিলো।
.
সবাই একটু টেনশনে পড়ে গেলাম। এদিকে
মেয়েটি কিছু চিপ্স জুস হাতে নিয়ে বাসে
ফিরে আসে। ফিরে আসতেই বয়স্কা মহিলাটি
তাকে একেরপর এক প্রশ্ন করে যায়। ....কি নাম
তোমার? কোথায় যাচ্ছ তোমরা? বাচ্চার বাবা
কি করে??
এতগুলো প্রশ্ন শুনে মেয়েটা একটু ঘাবড়ে যায়।
সন্দেহ সবার বাড়তে থাকে। সবার চোখ তখন
মেয়েটির দিকে।
বয়স্ক লোকটি এবার মুখ খুললেন..
"মা.. তোমার গালে এই অবস্থা কেন? কোনো
সমস্যা?"
.
মেয়েটি কেঁদে দেয়! আর বলতে থাকে...
"বিশ্বাস করেন ও আমার মেয়ে, ও আমার
টুকুনি" এই বলেই কাঁপতে কাঁপতে মোবাইলটা
বের করে একেরপর এক তাদের ছবি দেখাতে
থাকে!
মা সন্তানের পরিচয় দেয়ার জন্য প্রমাণের
প্রয়োজন হয় না, তাদের কেমিস্ট্রি দেখলেই
বুঝে নেয়া যায়। কিন্তু প্রমাণের জন্য মেয়েটি
এমন ছটফট করছে কেন!
বাসে আমরা পাঁচজন, চুপচাপ মনযোগ দিয়ে
তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম।
বড় বড় নিশ্বাস ফেলে মেয়েটি বলতে থাকে...
"আজ বিকেলে আমার মেয়েটাকে আমি চুরি
করেছি!!"
.
-- ওমা! বল কি! (বয়স্কা মহিলা)
.
হুম...(কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে আসে)
ওর বাবার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যায় ছয়
মাস আগে। তুচ্ছ কারন দেখিয়ে আমাকে
ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়। প্রবাস থেকে
দেশে ফিরেই অন্য আরেকটা বিয়ে করে বসে!
পরে পারিবারিক কলহের জের ধরে
বাচ্চাটাকেও তারা রেখে দেয়। বাচ্চাকে
তার সৎ মায়ের কাছে রেখে দিয়ে আবারো
সে প্রবাসে চলে যায়। বাচ্চাটির বাপ থেকেও
সে বাপের আদর পায়নি কখনো। এখন মায়ের
আদর থেকেও সে বঞ্চিত।
.
কথার মাঝপথে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম,
বললাম...
"আপনি আইনের সাহায্য নেননি কেন?
বাচ্চারতো এখনো পাঁচ বছর হয়নি!"
.
আইন! আমারদিকে তাকিয়ে হেসে উঠে!
হাসিতে দৃশ্যমান হয়ে আছে ঝলসে যাওয়া
কিছু পুরনো স্মৃতি।
(দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে বলতে থাকে)
... ... আমাদের মেয়েদের জন্য প্রচলিত আইনের
বাইরেও আরও একটি আইন আছে। যার নাম
পারিবারিক আইন! পারিবারিক আদালতে
কোনো হাইকোর্ট থাকে না। এখানে ন্যায়
অন্যায় চোখ বুজে মেনে নিতে হয়।
(চোখ মুছতে মুছতে বলে যায়.....) কথা ছিল
আমার মেয়েটার সাথে মাঝেমধ্যে তারা
দেখা করতে দেবে। এই কয়েকমাস বিকেলে
পার্কে এসে দেখা করে যেতাম। এর মধ্যেই
হঠাৎ পরিবার থেকে আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে
দিয়ে দেয়। ডিভোর্সি মেয়েকে দীর্ঘদিন
বসিয়ে রাখার মতন সামর্থ্য আমার পরিবারের
নেই।
পুরনো হাসব্যান্ড আমার দ্বিতীয় বিয়ের খবর
শুনে... টুকুনির সাথে দেখা করাটা পুরোপুরি
বন্ধ করে দেয়!
.
কেন?? (আমি)
.
বুঝেননি? হিংসা! হিংসা!
.
তার থেকে অনেক ভাল পজিশের একটি ছেলে
আমাকে বিয়ে করে নেয়। সেটা তার সহ্য হয়
না।
.
এই বিয়ের খবর শুনে ওরা আমার টুকুনির সাথে
ফোনে কথা বলাটাও প্রায় বন্ধ করে দেয়।
অনেক অনুরোধে সেদিন দুইমিনিটের জন্য কথা
বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। মেয়েটা যখন
ফোনে কেঁদে বলে উঠলো.. "আম্মু আমাকে
নিয়ে যাও, ওরা সবাই অনেক পঁচা..." আমি
সাথে সাথে আমার নতুন হাসব্যান্ডের হাত পা
ধরে কান্নাকাটি জুড়ে দিই। হয়তো জীবনে
কোনো পুণ্য কাজ করেছিলাম, শেষমেশ
অনুমতি পেয়ে যাই তাকে নিয়ে আসার। এক
মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে চলে আসি
মেয়েটাকে নিয়ে যেতে, কিন্তু টুকুনির সাথে
দেখা করতে দেয়াতো দূরের কথা উল্টো
আমার গায়ে হাততুলতেও বাদ যায়নি তারা!
মা হয়ে ঐ পাষাণদের কাছে আমার
কলিজাটাকে রেখে আসতে পারিনি। পড়নের
সব গহনা খুলে দিয়ে কাজের মেয়েটাকে
হাতের মুঠোয় নিয়ে আসি, তার সাহায্যেই
সুযোগ বুঝে টুকুনিকে আজ চুরি করে আনি।
আমি আমার টুকুনিকে ছাড়া থাকতে পারবো
না। একদমি না... এই বলেই বাচ্চাটির কপালে
চুমু এঁকে দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে
রাখে।
.
পিচ্চি মেয়েটা চুপ করে বড়দের কথোপকথন
গুলো শুনে যাচ্ছিল। এতকিছু বুঝার মতন বয়স
তার হয়নি। সে শুধু বুঝে, সে তার মায়ের কোলে
ফিরে এসেছে। তাকে আজ নতুন আব্বুর কাছে
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বিরতি শেষে বাসে লোকজনগুলো ফিরে
আসতে থাকে। আমরাও কথার টপিক ঘুরিয়ে
ফেলি। তাদের দু'জনের ভালোবাসার মাঝে
দ্বিতীয় কোনো প্রশ্নকরাটাও এমুহূর্তে
লজ্জাজনক।
.
.
বাস মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে চলছে। পুলিশের
চেকপোস্টের সামনে পড়তে হয়। দু'জন করে
পুলিশ সামনের বাসগুলোতে উঠে.. চেক করে
নেমে যাচ্ছে। মনেমনে প্রশ্নচলে আসে তারা
বাচ্চাটিকে খুঁজছে না তো?!
জানালা দিয়ে পুলিশ দেখে মেয়েটাও
ঘাবড়ে যায়। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বলি,,
"ভয় পাবেন না.. আপনি বাচ্চার মা, যদি ধরাও
খেয়ে যান আইন আপনার পাশেই থাকবে"
মেয়েটার ভয়ার্ত মুখ দেখে বৃদ্ধা মহিলাটি
আমাকে বলেন.. "বাবা তুমি আমার সিটে এসে
বস, আমি ওর পাশে গিয়ে বসি"
আমি উনার কথামতো সিট চেইঞ্জ করে
নিলাম।
মহিলাটি মেয়েটির কানে ফিসফিস করে কিছু
একটা বলে দেন। মেয়েটি তৎক্ষণাত
বাচ্চাটিকে গায়ের চাদর দিয়ে ঢেকে
ফেলে। এদিকে পুলিশ দু'জন বাসে উঠে
পড়েছে! আমরা যে ক'জন ঘটনা জানি সবার
ভেতরেই চাপা টেনশন শুরু হয়ে যায়।
পুলিশ দু'টি ডানে বায়ে তাকিমাকি করতে
করতে এগিয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময়
সার্জেন্টের সহকারী মেয়েটির সিটের কাছে
এসে থেমে যায়।
--- ম্যাডাম কাপড়টা একটু সরানতো
বাচ্চাটাকে একটু দেখি...
পাশথেকে বয়স্কা মহিলাটি রাগিস্বরে বলে
উঠেন..
--> অসভ্য! বেয়াদ্দব কোথাকার! বাসায় মা
বোন নেই?? দেখছ না বাচ্চাটি খাচ্ছে??!!
.
মায়ের চাদরের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা
হেংলা পাতলা সরু পা'দুটি দেখে বাচ্চাটির
বয়স নির্ণয়ের কোনো উপায় নেই।
অপরপুলিশটি ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তারা
যাকে খুঁজছে সে এত ছোট বাচ্চা না।
.
--- ওহ...স্যরি ম্যাডাম!
--> চেকিং করতে হলে তোমাদের লেডিস
পুলিশ পাঠিয়ে দাও।
--- না না ঠিকাছে খালাম্মা, সমস্যা নেই।
পুলিশ দু'টি বাস থেকে নেমে যায়!
.
বুকের উপর থেকে যেন ভারি পাথর সরে গেল!
একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে। তার বিপদটাকে
নিজেদের বিপদ বলে মনে হচ্ছিল। মা মেয়ের
ভালবাসাটা অজান্তেই আমাদের মন কেড়ে
নেয়, বুঝতেই পারিনি।
.
বাকি পথটুকু বাচ্চাটি আমাদের সবার কোলে
কোলে ঘুরে সময় পার করে দেয়। এতটুকুন বাচ্চা
মেয়ের মুখে পাকনা পাকনা কথাবার্তাগুলো
সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতন। আমার
"নতুন আব্বু" নাম পালটে "নতুন আঙ্কেল" নাম
রেখে দেয়। আর বয়স্কা মহিলাটির নাম দেয়
"বুড়ি মা"। বেশিরভাগ সময়টা বুড়িমার কোলেই
কাটিয়ে দেয়।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং নাম রাখে পাশে বসে
থাকা মেয়ে দু'টির। চোখে চশমা, তাই তাদের
নাম "চশমা আন্টি" কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার
হল বাচ্চাটি 'শ' বলতে পারে না... এজন্য
উচ্চারণ করতে গিয়ে নামটি হয়েগিয়েছিল
"চুমা আন্টি!!"
.
বাচ্চাটি অল্প সময়ে সবাইকে মায়ার জালে
বেঁধে ফেলে। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই
তারা তাদের গন্তব্যে নেমে যাবে। পথে মায়া
জাগানো কিছু মানুষগুলোকে পথেই ছেড়ে
যেতে হয়।
.
ভোরের আলো চারিদিক ছড়িয়ে গিয়েছে।
বাস থেকে নেমে যাচ্ছে তারা। বাহিরে
বাচ্চাটির নতুন আব্বু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা
করছে তাদের নিয়ে যেতে।
.
বাস থেকে নেমেই বাচ্চাটির মা বাবা দু'জনে
তাদের ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতে কদম
মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চাটি মায়ের
স্যালোয়ারের কার্নিশ খামচে ধরে গুটিগুটি
পায়ে পিছুপিছু হেঁটে যাচ্ছে। দৃশ্যটা মোটেই
প্রীতিকর নয়। লোকটি তার বউকে নিয়েই ব্যস্ত
হয়ে গেল, বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে দু'টি
কথাও বলল না! কিছু কিছু দৃশ্যপট গুলো
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে যায়। ভিতরটা খচখচ
করে ওঠে। কোনো ভুল হয়ে গেল না তো?
বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি এভাবে দৃষ্টির
আড়ালেই রয়ে যাবে?!
এদিকে বাসটাও পরের স্টেশনের উদ্দেশ্যে
যাত্রা শুরু করে দেয়।
এ্যাই বাস থামাও, বাস থামাও....! বয়স্কা
মহিলাটি চেঁচিয়ে ওঠে!
"বাস থামান" বলে আমিও দাঁড়িয়ে যাই!
বাসটি থেমে যায়। শেষ দৃষ্যটা না দেখতে
পেলে মোটেও শান্তি পাবো না। সবার দৃষ্টি
তখন জানালার বাইরে।
.
বাচ্চাটি সেভাবেই হেঁটে চলছে। হঠাৎ সে
তার নতুন আব্বুর শার্ট ধরে দু'বার টান দেয়।
লোকটি পেছন ফিরে তাকিয়ে সাথে সাথে
হাটুগেড়ে বসে পড়ে! গুরুত্বপূর্ণ কথার ছলে সে
তো ভুলেই গিয়েছিল বাচ্চাটির সাথে পরিচয়
হয়ে নিতে। দৃশ্যপট মুহূর্তেই পালটে যায়।
বাচ্চাটি ছোট্ট সেই পকেট থেকে চকলেট বের
করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমি মনেমনে বলে যাচ্ছি... "আরে আরে
এটাতো সে আমাকে দিয়েছিল!!" বুক পকেটে
হাত দিয়ে দেখি পকেট ফাঁকা! চকলেট নেই!!
কোন ফাঁকে যেন বাচ্চাটি ঠিকই তার নতুন
আব্বুর জন্যে রেখে দেওয়া চকলেটটি ফিরিয়ে
নিয়েছে! হা হা!
চকলেট এগিয়ে দিয়ে নতুন আব্বুকে কিছু একটা
বলে যাচ্ছে...
যদিও এখানথেকে শোনাযাচ্ছে না, তবে হ্যাঁ
আমি শিওর... সে ঐ কথাটাই বলছে... "এইটা
তোমাকে নিতেইইই হবে!!" আর এমন কথা শুনার
পর কোন পুরুষ মানুষ যদি সত্যিই মানুষ হয়ে
থাকে সে কখনওই এমন বাচ্চাটিকে ফিরিয়ে
দিতে পারবে না।
যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনটাই হয়ে
গেল। নতুন বাবা.. বাচ্চাটির চকলেট সহ পুরো
বাচ্চাটিকেই কোলে তুলে নেয়! বোচা নাকটি
ধরে টেনেটেনে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে
তাদের গাড়িটির দিকে এগিয়ে যায়।
.
দৃশ্যপটের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকা
সবার চোখের কোণেই পানি! বাচ্চাটি
জানালা দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আমাদের
বিদায় দিয়ে যাচ্ছে। আমরাও হাত নেড়ে
বিদায় দিয়ে দিলাম।
বয়স্কা মহিলাটি চোখের পানি ফেলতে
ফেলতে বলতে থাকে...
"ভাল থাকিস বুড়ি মা!!"
জানালার কাঁচ ভেত করে বৃদ্ধার কথাটি
বাচ্চার কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তবে
সেটা দু'আ হয়ে উপর আল্লাহ্'র কাছে হয়ত
অবশ্যই পৌঁছে যাবে।